wave তরঙ্গ
যে পর্যায়বৃত্ত আন্দোলন কোনো জড় মাধ্যমের একস্থান থেকে অন্যস্থানে শক্তি সঞ্চালিত করে কিন্তু মাধ্যমের কণাগুলোকে স্থায়ীভাবে স্থানান্তরিত করে না তাকে তরঙ্গ বলে।
কঠিন, তরল বা গ্যাসীয় মাধ্যমে যে তরঙ্গের উদ্ভব হয় তা যান্ত্রিক তরঙ্গ। পানির তরঙ্গ, তরুল প্রভৃতি যান্ত্রিক তরঙ্গ। যান্ত্রিক তরঙ্গ সঞ্চালনের জন্য স্থিতিস্থাপক মাধ্যমের প্রয়োজন। আর এক ধরনের তরঙ্গ আছে বা সঞ্চালনের জন্য কোনো মাধ্যম লাগে না। এটা হলো তাড়িতচৌম্বক তরঙ্গ।
তরঙ্গের বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নরূপ
১. মাধ্যমের কণাগুলোর স্পন্দন গতির ফলে তরঙ্গ সৃষ্টি হয় কিন্তু কণাগুলোর স্থায়ী স্থানান্তর হয় না।
২. যান্ত্রিক তরঙ্গ সঞ্চালনের জন্য মাধ্যম প্রয়োজন।
৩. তরঙ্গ একস্থান থেকে অন্যস্থানে শক্তি সঞ্চালন করে।
8. তরঙ্গের বেগ মাধ্যমের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে।
৫.তরঙ্গের প্রতিফলন, প্রতিসরণ ও উপরিপাতন ঘটে।
তরঙ্গের প্রকারভেদঃ
১) অনুপ্রস্থ তরঙ্গ ২) অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ
আড় তরঙ্গ বা অনুপ্রস্থ তরঙ্গ (Transverse wave) : জড় মাধ্যমের কম্পনরত কণাসমূহ তরঙ্গ প্রবাহের সমকোণে কম্পিত হলে বা তরঙ্গ প্রবাহের অভিমুখ ও মাধ্যমের কণাসমূহের কম্পনের অভিমুখ পরস্পরের সমকোণী হলে ঐ তরঙ্গকে আড় তরঙ্গ বা অনুপ্রস্থ তরঙ্গ বলে। যেমন- আলোক তরঙ্গ, বেতার তরঙ্গ ইত্যাদি।
ব্যাখ্যা : চিত্রে একটি অনুপ্রস্থ তরঙ্গ দেখান হয়েছে। তরঙ্গের উপর ছোট ছোট তীর চিহ্ন দ্বারা কণার কম্পনের অভিমুখ দেখানো হয়েছে তরঙ্গের উপরের দিকে A ও E বিন্দুতে কণার সর্বোচ্চ সরণ ঘটেছে। তরঙ্গের এই বিন্দুগুলোকে তরঙ্গ শীর্ষ মুখ বা তরঙ্গ চূড়া (Crest) বলে। আবার নিচের দিকে বিন্দুতে সর্বোচ্চ সরণ ঘটেছে। একে তরঙ্গ পাদ বা তরঙ্গ খাঁজ (Trough) বলে।
এক্ষেত্রে কণার স্পন্দনের অভিমুখ তরঙ্গ প্রবাহের অভিমুখ সমকোণে ঘটেছে অতএব এটা আড় তরঙ্গ।
উদাহরণঃ
(১) পুকুরের পানিতে ঢিল ছুঁড়লে দেখা যায় যে পানির কণাগুলো উপরে-নিচে দুলতে থাকে এবং এই আন্দোলন কিনারার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সৃষ্ট এরূপ আন্দোলনই আড় তরঙ্গ বা অনুপ্রস্থ তরঙ্গ।
(২) উপরের চিত্র অনুযায়ী একটি তার টান করে বেঁধে এর দৈর্ঘ্যের সমকোণে টেনে ছেড়ে দিলে তারে একটি তরঙ্গের সৃষ্টি হবে । লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, তারটি এর দৈর্ঘ্যের সাথে সমকোণে আন্দোলিত হচ্ছে। এই আন্দোলন তারের দৈর্ঘ্য বরাবর প্রবাহিত হচ্ছে। সুতরাং টানা তারের এরূপ কম্পন হতে স্পষ্ট যে, এই তরঙ্গ আড় তরঙ্গ।
আড় বা অনুপ্রস্থ তরঙ্গের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of transverse wave):
আড় তরঙ্গের মধ্যে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়—
১। যে তরঙ্গের ক্ষেত্রে জড় মাধ্যমের কণাগুলির কম্পনের দিক তরঙ্গ প্রবাহের দিকের সমকোণী হয়, তাকে আড় তরঙ্গ বলে।
২। তরঙ্গ প্রবাহে মাধ্যমে তরঙ্গ শীর্ষ এবং তরঙ্গ পাদ সৃষ্টি হয়।
৩। পর পর দুটি তরঙ্গ শীর্ষ বা পর পর দুটি তরঙ্গ পাদের মধ্যবর্তী দূরত্বকে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বলে।
৪। মাধ্যমে এর সমবর্তন বা পোলারণ ঘটে।
৫। অনম্যতার বা আকৃতির স্থিতিস্থাপক ধর্মসম্পন্ন মাধ্যমে (কঠিন) এই তরঙ্গ উৎপন্ন হয়। প্রবাহীতে পৃষ্ঠটানের দরুন আড় তরঙ্গের সৃষ্টি হয়।
লম্বিক তরঙ্গ বা অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ (Longitudinal wave) : জড় মাধ্যমের কণাসমূহ তরঙ্গ প্রবাহের দিকে কম্পিত হলে অথবা জড় মাধ্যমের কণাসমূহের কম্পনের দিক এবং তরঙ্গ প্রবাহের দিক পরস্পর সমান্তরাল হলে ঐ তরঙ্গকে লম্বিক তরঙ্গ বা অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ বলে।
যেমনঃ শব্দতরঙ্গ, স্প্রিং এ সৃষ্ট তরঙ্গ, ঢোলের বাড়ি দিলে সৃষ্ট তরঙ্গ এবং বাশির সুর অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ।
বায়বীয় মাধ্যমে শব্দ তরঙ্গ সঞ্চালনকালে মাধ্যমের স্তরসমূহের সংকোচন ও প্রসারণ তরঙ্গ প্রবাহের দিকে ঘটে [উপরের চিত্রে ]। কাজেই শব্দ তরঙ্গ লম্বিক তরঙ্গ। উপরের চিত্রে বায়বীয় মাধ্যমকে কতকগুলো মান স্তরে বিভক্ত দেখানো হয়েছে।তরঙ্গ প্রবাহের দরুন কোন মুহূর্তে মাধ্যমের স্তরগুলো পরস্পরের কাছাকাছি এসে ঘেঁষাঘেষিভাবে অবস্থান করে [উপরের চিত্রে ]। একে সংকোচন বলে। আবার পরবর্তী মুহূর্তে স্তরগুলো পরস্পর হতে দূরে সরে গিয়ে ফাঁক ফাঁক হয়ে অবস্থান করে। একে স্তরসমূহের প্রসারণ বলে। সুতরাং বায়বীয় মাধ্যমের কণাগুলো তরঙ্গ প্রবাহের সমান্তরালে ডানে-বামে পর্যাবৃত্ত কম্পনে কাঁপতে থাকে।
উদাহরণঃ
একটি স্প্রিং-এর এক প্রান্ত কোন দৃঢ় অবলম্বনে আবদ্ধ করে অপর প্রান্ত ধরে খানিকটা টেনে ছেড়ে দিলে স্প্রিং-এর কুণ্ডলীসমূহ পর্যায়ক্রমে সংকুচিত ও প্রসারিত হয় [উপরের চিত্রে] এবং তরঙ্গ স্প্রিং বয়ে অগ্রসর হয়। এই তরঙ্গ লম্বিক তরঙ্গ। কেননা সংকোচন ও প্রসারণের দরুন স্প্রিং-এর কণাসমূহ তরঙ্গ প্রবাহের অভিমুখের সমান্তরালে ডানে-বামে পর্যাবৃত্ত কম্পনে কম্পিত হয়।
তরঙ্গ প্রবাহের মাত্রার (dimension) উপর নির্ভর করে তরঙ্গকে একমাত্রিক, দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক তরঙ্গ বলা হয়। উপরের দৃষ্টান্তে রশিতে বা স্প্রিং-এ যে তরঙ্গ সৃষ্টি করে দেখানো হয়েছে, তা একমাত্রিক তরঙ্গ। আবার পুকুরের পানিতে ঢিল ছুঁড়লে যে তরঙ্গ পানির তলে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে তা দ্বিমাত্রিক তরঙ্গ। কোন আলোক উৎস থেকে যে আলোক তরঙ্গ উৎপন্ন হয়, তা সবদিকে (ডানে-বামে, উপরে-নিচে) সঞ্চালিত হয় এবং এ ধরনের তরঙ্গ হবে ত্রিমাত্রিক তরঙ্গ।
0 Comments